বিবাহ

 

(ছবি সৌজন্যে ইন্টারনেট) 

আস্তে আস্তে সুন্দর ভাবে কাছে ডাকিয়া কানে কানে দাদু বলিলেন,সব্যসাচির মধ্যম পুত্রটি ও তুমি তো একই কলেজে পড়ো। নাতনি বলিল, তাতে কি হইয়াছে, কলেজ থাকিলেই তাহাতে কত শত ছাত্র ছাত্রী এক সঙ্গে পড়িয়া থাকে। দাদু বলিলেন রাগ করিতেছ কেন দিদি ভাই।ঐ ছেলেটা তোমার পছন্দ হয় কিনা তাই জানিতে চাইতেছি। ছেলেটা কেমন ভালো না খারাপ সেটা তো তুমি বলিতে পারিবে।
রাগ দেখিয়ে নাতনি বলিল, ছেলেটা কেমন তাহা আমি বলিব কি করিয়া। তাছাড়া পছন্দের কথা উঠিতেছে কেন?
দাদু শান্ত ভাবে বলিলেন, সব্যসাচি একটা সুকণ্যার সন্ধান করিতেছে। নাতনি ও আরো শান্ত ভাবে বলিলো এখন আমার পক্ষে বিবাহ করা একদমই সম্ভব নয়। আমি কি ঘর ভাঙ্গিয়ে চলিয়া যাইতেছি। দাদু বলিলেন আরে তোমার জন্য নয়, ছোটো নাতনি সীতার জন্য। পাগলের মত হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিয়া পাপিয়া বলিলো এতো টুকু মেয়ের বিবাহ হইবে কি করিয়া। তুমি কি ঠাট্টা করিতেছ দাদু ভাই।
দাদু বলিলেন ঐ টুকু মেয়ে আবার কি? শাস্ত্রে আছে দ্বাদশ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিবাহ না দিলে তাহাকে সতীনারী বলে না। নাতনি বলিলো, সেই রাম ও নাই আর অযুধ্যা ও নাই এখন কারদিনে মেয়েদের আঠেরো বছরের আগে বিবাহ হইলে তাহাকে অসতী বলে গো দাদু। দাদু বলিলেন, আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারিতেছ। আরও বলিলেন,অল্পবয়সে বিবাহ হইলে তাহারা অসতী হয় আর বুড়িধাড়ী হইয়া বিবাহ হইলে সতী হয়। বালাই সাট কেন যে আমার মরণ হয় না দয়াল ঠাকুর। রাগিতেছ কেন দাদু রাগিতেছ কেন, অসতী কথাটা এমনি বলিলাম।
আসলে আঠেরো বছরের নিচে মেয়েদের বিবাহ আইন বিরুদ্ধ কাজ। দাদু বলিলেন তাহাতো হইবে এখন তো দেশ শিক্ষিত হইতেছে । গীতা, রামায়ণ, মহাভারত সব মিথ্যে হয়েছে মিথ্যে।
আচ্ছা দাদু আমার কি তবে এখনও আঠেরো বছর পার হয় নাই। দাদু এবার সত্যি সত্যি রাগিয়া বলিলেন, তুমি তো বিবাহ করিবে না বলিয়া পণ করিয়াছ। তোমার জন্য সু পাত্র আনিতে আনিতে নাজেহাল হইয়া হাল ছাড়িয়া দিয়াছি। দাদু নাতনির ঝগড়া বন্ধ হইল আপাতত।এই দুই জন ছাড়া আর কেহ বিবাহের কথা জানিতে পারিল না। খাওয়া দাওয়া সারিয়া রাত্রে সবাই যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়িল। শুধু ঘুম আসিলো না পাপিয়ার চোখে। কাজটা আইন বিরুদ্ধ হইলেও তাদের বাড়িতে বিবাহ অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়া আনন্দে তাহার মন নাচিতে লাগিল। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করিতে লাগিল যে, ঠাকুর যেন বিবাহ অনুষ্ঠান হয়।
কত আনন্দ হইবে, এই বাড়িতে জামাই আসিবে। সে মনে মনে বলিল সত্যি দাদু কি ভালো। পাপিয়া এই বার সেই ছেলেটির কথা ভাবিতে লাগিল। সব্যসাচি বাবুর ছেলের নাম তো গৌরহরি । আমাদের কলেজে পড়তো, সে এবার বি এ পরীক্ষা দিয়েছে। ছেলেটা খুব নরম কাহারো সহিত কথা বলিত না। বিশেষ করিয়া কোনো মেয়ের সহিত কথা বলিতে তো আমি দেখি নাই। অতএব উহার স্বভাব চরিত্র নিশ্চয় খুব ভালো। এই সব ভাবিতে ভাবিতে এক সময় তাহার ঘুম আসিলো। পরের দিন সকালে বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া তাহার কেমন খুশি খুশি মনে হইতেছে। শুধু পাপিয়ার নয় সমস্ত বাড়িতে যেন খুশির বন্যায় ভরে উঠিয়াছে।কারণ ঐ দিন বাড়ির সবাই ব্যাপারটা জানিয়া গিয়াছে। প্রথমত বাড়ির সবাই একটু আধটু অভিযোগ তুলেছিলেন। যে এত টুকু মেয়ের বিবাহ দেওয়া উচিৎ নয়। কিন্তু শ্যামবাবু সবাইকে এই বলিয়া বুঝিয়েছিলেন যেএত ভালো ঘর ও বর এক সাথে পাওয়া যায় না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাই হোক এই বাড়িতে বিবাহ অনুষ্ঠান হইবে ভাবিয়া সবাই আনন্দ করিতে লাগিল। বিবাহের পর শ্বশুর গৃহ সংসার স্বামী সন্তান ইত্যাদি উপসর্গ আসিয়া ভীড় করিয়া থাকে তাহা বুঝিবার মতো বুদ্ধি কিন্তু সীতার হয় নাই। তাহার একটাই অভিযোগ যে, বড়ো দিদিকে রাখিয়া আমাকে আগে বিবাহ দেওয়া হইবে কেন? ওকে এই বলিয়া বুঝানো হইল আরে তোকে তো দেখিতে আসিতেছে। দেখিতে আসিলে কি বিবাহ হয় নাকি। পাপিয়ার তো কত বার দেখিতে আসিয়াছে, ওর কি বিবাহ হইয়াছে। ওর তো এখনো বিবাহ হয় নাই। ঘরে মেয়ে থাকিলে মানুষ দেখিতে আসে। পরের দিন সোমবার মেয়ে দেখিতে আসিবে। সাধ্যমতো ঘর বাড়ি সাজানো গুছানো হইল। এমনকি পাত্রপক্ষের সেবা যত্নের সু ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো। সোমবার দুপুর বেলায় সব্যসাচিবাবু ও তাহার এক জামাই নিমাই চাঁদ কণ্যা দেখিতে আসিলেন। যথা সাধ্য তাহাদের যত্ন করা হয়েছিল। এই বার কণ্যা দেখিবার সময় উপস্থিত হইল। কিন্তু হঠাৎ সীতা গো ধরিয়া বসিল যে, দিদি থাকিতে আমি যাইব না। দিদি কে যাইতে বলো, দিদিকে দেখিয়া যাউক বলিতে বলিতে কাঁদিয়া ফেলিল। তাহাকে অনেক বুঝাইয়া সুঝাইয়া সাজাইয়া গাজাইয়া দিদির সহিত পাত্রপক্ষের সম্মুখে উপস্থিত করা হইলো।
সব্যসাচি আবার একটু জতিষি ছিলেন। তিনি কণ্যা দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন ও শেষে পাত্রির হাত দেখিয়া আনন্দিত চিত্তে বলিলেন যে এই কণ্যাকেই তিনি পূত্রবধু করিয়া লইয়া যাইবেন। হাত দেখিয়া কি বুঝিলেন তাহা তিনি প্রকাশ করিলেন না। শুধু বলিলেন সীতা খুব ভাগ্যবতী মেয়ে।শ্যামবাবু বলিলেন বড়ো নাতনির হাতটা একটু দেখিয়া দিন। পাপিয়া প্রথমে একটু ইতস্তত করিল কারণ সে কাহাকে হাত দেখায় না। সবার পিড়া পিড়িতে হাতটা শেষে দেখাইলো । সব্যসাচিবাবু পাপিয়া ও সীতার ভাগ্য নিয়ে আলোচনা করিলেন। যেমন সীতার ভাগ্য খুব ভাল কিন্তু পাপিয়ার ভাগ্য খুবই খারাপ। সীতার যদি ভিক্ষিরির সঙ্গে বিবাহ হয় আর পাপিয়ার যদি লক্ষপতীর সঙ্গে বিবাহ হয় তবে সীতা লক্ষপতী ও পাপিয়া ভিক্ষিরি হয়ে যাবে। আরো অনেক কথা তিনি বলিলেন, মানে সীতার দিকটা ভালো আর পাপিয়ার দিকটা খারাপ। সেই দিন কার মতন কথা বার্তা শেষ হইল। দিনটা ছিল ৪ঠা বৈশাখ রবিবার। সব্যসাচিবাবু বাজারে গিয়ে যাদববাবুকে বলিলেন যে, আমি আগামী ৭ই বৈশাখ বুধবার বিবাহ সম্পূর্ণ করিতে চাই। যাদববাবু সীতার বাবা , তিনি এই কথা শুনিয়া আকাশ থেকে পড়িলেন। বলিলেন এত তাড়াতাড়ি কি করিয়া সম্ভব। সব্যসাচিবাবু বলিলেন সব ভগবানের ইচ্ছা। তিনি যা করবার করবেন। বাড়িতে সবাই তো অবাক, সবাই এর মুখে একটা কথা, এত তাড়াতাড়ি। সবাই ভেবেছিল শুধু দেখাশোনা হয়ে বন্ধ হয়ে থাকবে। পাপিয়ার যেমন হয়।
কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই দেখিয়া, সবাই বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য তৈরী হতে লাগিল। সীতাকে বুঝানো হইল বিয়ের পর সে এই বাড়িতে থাকিবে যত দিন পর্যন্ত সে নিজের ইচ্ছায় ঐ বাড়িতে না যাইবে। কারণ সব্যসাচিবাবু এই কথা তিনি নিজেই দিয়েছেন। বাচ্চা মেয়ে যা বুঝানো হলো তাই বুঝলো। এদিকে পাপিয়া ও ভেবেছিল সে যাকিছু ভাবুক না কেন, বিবাহটা মেয়ে দেখার পর থেমে যাইবে। কিন্তু সেটা কখনোই সম্ভব নয় দেখিয়া পাপিয়া গো ধরিলো এই সব ছেলে খেলা বন্ধ কর। এত ছোটো মেয়ের বিবাহ দেওয়া হইলে অনেক অশান্তি দেখা দেবে। সবাই পাপিয়াকে রাগ করিতে লাগিল। বলিল এই দিকে সব ঠিক হয়েছে যখনি তখন তোর এমন করা উচিত নয়। প্রচুর টাকা ধার করিয়া এবং তাহার পিতার দোকান বন্ধক রাখিয়া বিবাহ ব্যাবস্থা করা হয়েছে,জানিয়া পাপিয়া বিবাহ বন্ধ করিতে বলিয়াছিল। কিন্তু অন্য কেউ যখন তাহা চায় না তখন সে আর বাধা দিবে কেন। দোকান বন্ধক দিতে লাগিল না, কারন যে বন্ধক রাখিবে তিনি এমনিতেই টাকা ধার দিলেন। যাইহোক এই ভাবে অনুষ্ঠানের ও বরপক্ষের দান ধ্যানের ব্যবস্থা সাধ্য মত করা হইলো। সবাই মিলিয়া খুব কষ্ট করিল অনুষ্ঠানকে সুন্দর করার জন্য।
এলো আশির্বাদের দিন, আগে ছেলের আশির্বাদ হইবে। পাপিয়ার দাদু কয়েকজনকে নিয়ে আগেই চলে গিয়েছিল। পরে পাপিয়া ও তার এক দিদি গেল। পাত্রের বাড়ি ডুকবে এমন সময় একটা মেয়ে বললো তুমি তো সীতার দিদি তাই না? পাপিয়া বলিল তুমি ঠিক ধরেছো, কেন বলতো? সে বলিল এই দিকে এসে কথা শোন। পাপিয়া ওর সঙ্গে কিছু দুর গেল। সে তখন বলল যে, গৌরের সঙ্গে ঐ বাড়ির একটি মেয়ের সঙ্গে বাজে সম্পর্ক আছে। পাপিয়া কিন্তু এই কথা শুনিবার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে কিছুটা ঘাবড়ে গেল, এবং নিজেকে সে সামলে নিলো।ভাবলো বিয়ের আগে অমন একটু আধটু হইয়া থাকে, বিবাহ হইলে সব ঠিক হইয়া যায়। ওরা বাড়ির ভিতরে গেল, যত্ন আহ্বান ও ঠিক ঠিক হইলো। কিন্তু পাপিয়ার কোথায় যেন একটু বাঁধো বাঁধো লাগছে ।
পাপিয়া ওর দিদিকে ঐ মেয়ের বলা সব কথা খুলে বলল। ওর দিদি বলল ঐ সব ভাবিসনা, বিয়ের পর সব ঠিক হইয়া যাইবে। তবুও সস্তি পাচ্ছে না পাপিয়া। গৌর বাড়ি আসিলে অনেক গল্প করিলেন। তারপর গৌরকে লইয়া পাপিয়া ও তার দিদি রাস্তার দিকে ঘুরিতে গেল। কথায় কথায় ঐ কথাটা আলোচনা করিল। গৌর বলিল আমি জানতাম ঐ কথা তোমাদের কানে উঠিবে। তোমরা ঐ কথা বিশ্বাস কর? পাপিয়া বলিল বিশ্বাস করিলে ফিরিয়া যাইতাম সরাসরি আলোচনা করিতাম না। তবে আমার বিশ্বাস বিবাহের আগে কিছু থাকিলে সেটা বিবাহের পর ঠিক হইয়া যায়। তাছাড়া আমার বোন খুবই ছোট। বিবাহ, স্বামী, সংসার এই সব জ্ঞান তাহার হয় নাই। ওকে তোমার নিজের মতন করে গড়ে তুলতে হবে। গৌর বলিল ঐ সব নিয়ে ভেব না সব ঠিক হইয়া যাইবে। পাপিয়া বলিল আমি নিশ্চিন্ত হইলাম। যথা সময়ে চার হাত এক হইল।
                                                                    সুলেখা দেবনাথ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ