সে দিনের কথা


(ছবি ইন্টারনেট থেকে)


সেদিন তুমি ছিলে অপ্রকৃতিস্থ , তোমার পা টলছিল, গলা ভারি ছিল , চোখের চাহনি ছিল অন্য রকম। আমি কিন্তু বিশ্বাস করিনি। একটু ও বিশ্বাস করিনি। কারন তুমি যে বলো, আমি তোমাকে অবিশ্বাস করি হয়তো তাই। ঐ দিন তোমার একটু অভিমান হয়েছিল। তুমি বলেছিলে,আজ খেয়ে বাড়ি আসবো, তখন দেখবি। আমি কানেই তুলিনি। আমার বিশ্বাস আর পাঁচ জনের মতো তুমি হতে পারো না। কিছুতেই না।
কিন্তু তোমার মুখের কথা, আমার কাছে সব থেকে বড় সত্যি। তুমি যখন বললে, সে দিন তো খেয়ে এসেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলে? বাড়িতে ও আনবো, রোজ একটু করে খাবো।
আজ থেকে তোমার আমার ভালো বাসা উপন্যাস সৃষ্টি হলো। একদিন প্রতিঞ্জা করেছিলাম কাগজ কলম আর এ জীবনে ধরবো না।

কারণ আমার লেখা পড়া তোমার ও তোমার পরিবারের লোকজনের কাছে এমন একটা জিনিসের সঙ্গে সমতুল্য যা আমার পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। সে দিন তুমি আমায় লিখতে সাহায্য করেছিলে। তুমি আমার প্রেরণা, তুমি আমার শক্তি, তুমি আমার আদর্শ।

সেদিন আমি ভেবেছিলাম অন্য একটা ভাবনা। ঐ দিকটা ঐ ওপারে একটা পাখি সাথি হারা হয়ে কুহু কুহু সুরে এক ভাবে ডেকে চলেছিল। ওর ডাকের উত্তর কেউ দিলনা। হয় তো বা ওর কাছে কেউ ফিরে ও এলো না। ডাকতে ডাকতে এক সময়ে ওর গলা ক্ষীণ হয়ে এলো। তারপর আস্তে আস্তে সে ডাক থেমে গেল। ক্লান্ত হয়ে পাখিটি মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ সাইকেলের শব্দ । কে, কুনাল এসেছে নিশ্চিত।আজ কিন্তু সে সুমালার নাম ধরে  ডাকল না। সুমালার বুঝতে বাকি রইলো না যে কুনাল আজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার সময় অভিমান করে যে কথা বলে বেরিয়েছিল তার অভিনয় করছে। সুমালা কিছু না বোঝার ভান করল। কুনাল হাত পা ধুয়ে খেতে গেল। তারপর তারা শুয়ে পড়ল। সুমালা আস্তে আস্তে কুনালের মুখে কোনো বাজে গন্ধ আছে কি না বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু সে কিছু বুঝতেই পারল না। সুমালা ভাবল যে তার মনের ভুল।

তার পর তারা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন ঐ সব কথা সে মনে ও রাখেনি, সব কথা সে ভুলে গেল। কিন্তু দুদিন পর কুনাল নিজের মুখে যখন বলল ঐ রাতের কথা। তখন সুমালার আজ থেকে তার পাঁচ বৎসর বয়স পর্যন্ত সব কথা মনে পড়ে গেল। সুমালা ভাবছিল,

আমার বয়স যখন পাঁচ, আমি ও প্রকৃতির নিয়মে খেলার সরঞ্জাম নিয়ে বউ বউ খেলছিলাম।
আমার ঠাকুরমা আমাকে একটা লাল ছাপার শাড়ি কিনে দিয়েছিল। না না বড়োদের মতো বড়ো শাড়ি নয়। ছোটোদের সুন্দর একটা ছোট্ট শাড়ি। আমি সে কাপড় পরে প্রতিদিন বৌ বৌ খেলতাম। কুচি দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ছোট্ট একটা বৌ সাজতাম। আমার হাড়ি কড়া গামলা থালা গেলাস হাতা খুন্তি আরও কত কি ছিল।

ধুলো দিয়ে ভাত, শাক পাতার তরকারি, জলের মধ্যে ধুলো দিয়ে ডাল রান্না করতাম। ছোটো ছোটো পুতুল গুলো ছিল আমার ছেলে মেয়ে। কিন্তু আমার বর ছিল না।

এক দিন আমার ঠাকুর মা আমাকে ধরে নিয়ে এলো, আমি তখন কাপড় পরে ঘোমটা টেনে ছোটো একটা বৌ সেজে আছি। এসে দেখি আমাদের উত্তরের ঘরের বারান্দায় বসে আছে কতো গুলো ছেলে। তাদের হাতে বই খাতা, ওরা সবাই স্কুলে যাচ্ছে। আমার কাকু আর ওরা এক সঙ্গে স্কুলে যাওয়া আসা করে। তাই ওরা আমার কাকুর জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের বাড়িতে ওরা সবাই আরও আসত, আমার মেঝকাকুর কাছে  খেলা ও ব্যায়াম শিখতে। ঠাকুর মা আমাকে বলল ঐ দ্যাখ ঐ যে ওদের মধ্যে বসে আছে ও তোর বর। ওর সঙ্গে তোর বিয়ে দিয়েছি।

ওখানে যারা বসে ছিল তারা সবাই হেসে উঠেছিল। শুধু বর আমার চোখের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করেছিল। বরের বয়স তখন বারো হবে। বর কথার মানে সে খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিল। তাই হয়তো সে লজ্জা পেয়েছিল। আর আমি ঠাকুরমার কাছ থেকে হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে দে দৌড়।

কিন্তু আমার মা ছিল নাছড় বাধা। তিনি সব সময় বলতেন, তোকে বিয়ে দেব না। বিয়ের মতো জ্বালা আর নেই। বিয়ে করলে খুব কষ্ট পেতে হয়, খুব দুঃখ, যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়। তুই লেখা পড়া শিখে অনেক বড়ো হবি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, তবে স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারবি।

মায়ের এই সব কথা শুনে আমার খুব রাগ হত।

কেন আমি বিয়ে করবো না,কেন বৌ হব না? এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি তখন বারো পার করে তেরোর ঘরে পা দিয়েছি।আমি তখন আমার মায়ের বলা কথার মানে বুঝতে শিখেছি। আমার মা ও আমার মতো ছোট ছিল। তখন আমার মতোই পুতুল নিয়ে খেলত বৌ সাজত। কোন মেয়ে না বৌ সাজার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কটা মেয়ের স্বপ্ন সত্যি হয়।

এই সব ভাবতে ভাবতে তিনি ও এক দিন বৌ সাজার বয়সে পৌঁছে গেলেন। নদীর স্রোত যেমন কারুর কথা শোনে না, সময় যেমন কারুর জন্য অপেক্ষা করে না, তেমন বয়স ও বাধা মানে না। তাই আমার দাদামশাই কোমর বেঁধে বেরিয়ে পড়লেন _জামাই খুজতে। একমাত্র মেয়ের জন্য ভালো জামাই চাই। ভালো ঘর চাই, ভালো চাকরি চাই, ভালো পরিবেশ চাই ইত্যাদি।

বিভিন্ন জায়গায় খুজতে খুজতে পেয়ে গেলেন তার মনের মতো জামাই। সুন্দর চেহারা, ভালো শিক্ষিত, চাকুরীর সাথে ব্যবসাদার, ভালো ঘর ও খুব বড়লোক। তবুও আমার মা আমাকে বিয়ে দিতে চায় না।কারন আমার বাবা ছিলেন অন্য রকম।

            তাই আমার মা আমাকে বৌ সাজিয়ে কষ্টে ফেলতে চায় না। কিন্তু আমি তখন ভালই বুঝি, মনে মনে ভাবলাম না মা না,বৌ আমি হব। তবে ঐ রকম লোকের বৌ না। আমি টাকা চাই না,গাড়ি বাড়ি চাই না, রূপ চাই না, আমি চাই একটা মানুষ, একটা বুদ্ধিমান মানুষ। যার মধ্যে থাকবে মান আর হূশ।

      চৌদ্দ বছর বয়স থেকে সুমালা অর্থাৎ মালার মানুষ খোজা শুরু হলো। তার সেই পাঁচ বছর বয়সের বরের কথা বেমালুম ভুলে গেল। মালার মানুষ খোজার অর্থ এই নয় যে, সে কোমর বেঁধে নেমে পড়ল গ্ৰামের পর গ্ৰাম ,তার মনের মানুষ খোজার জন্য।

           তাদের বাড়িতে একেরপর এক আসতে লাগলো মেয়ে দেখার জন্য। এদের মধ্যে কেউ বা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মাষ্টার কিংবা কোন অফিসার ও কোনো ব্যবসাদার ইত্যাদির মানুষ ছিলেন।
মালা তো এই সব মানুষ চায় না, তাই সে কোনো মতামত প্রকাশ করত না। আর মালার বাবা এত অল্প বয়সে মেয়েদের বিবাহ হবে এটা চায় না।

           তবে মালার দাদুর খুব ইচ্ছা নাতনির বিয়ে দিয়ে নাতজামাইয়ের মুখ দেখে।

        মালা যখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী তখন থেকেই পাত্র দেখা শুরু করেছে। যত জায়গা থেকে পাত্র এসেছে সকলে মালাকে পছন্দ করেছেন। কারণ ও ছিল যথেষ্ট সুন্দরী ও লেখা পড়ায় ভালো।
কিন্তু ওর স্বভাব ছিল অন্য রকম। ইচ্ছা হলে কারুর সঙ্গে কথা বলত, ইচ্ছা না হলে কাউকে পাত্তা দিত না।
        এক এক করতে করতে এবার মালা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল। পাত্র পক্ষের মধ্যে অনেকে ভাবলো, যদি ফেল করে তবে বিয়ে দিতে পারে। কথাটা মালার কানে উঠল, সে ও মুখের উপর জবাব দিলো, হাঁ করে বসে থাকো। যাতে আমি ফেল করি।

হই হই করতে করতে দিন যেতে লাগলো। কত জায়গায় ঘোরা হলো, কতো যাত্রা, কতো সিনেমা ও মেলা দেখা হলো। কত সোয়েটার,আসন, তোয়ালে, রুমাল ও নানান রকম হাতের কাজ করা হল। দেখতে দেখতে রেজাল্ট বের হয়ে গেল। যদিও ফলটা মনের মত হলো না তবুও খুব একটা খারাপ হয় নি।

       এবার নতুন জীবনে প্রবেশ করার দিন চলে এলো। সেদিন ছিল ১লা ভাদ্র, অনেকে বাধা দিল, আজ যেয়ে কাজ নেই।

       কারণ ১লা ভাদ্রের দিনে অগস্ত্য মুনি যাত্রা করে আর ফিরে আসে নি। কার সঙ্গে কার তুলনা। মালা এই সব কথা কানে তুললো না, সে তার বাবার সঙ্গে এগিয়ে চলল কলেজের দিকে। ওর বাবা বলল, আজ থেকে তোমার আমার মধ্যে শুধু টাকার সম্পর্ক থাকল। তোমার দরকার মতো টাকা আমি পাঠাব, তুমি তোমার মতো মন দিয়ে পড়াশুনা করবে।

           কথাটা ভালো ছিল কিন্তু টাকার সম্পর্ক কথাটা মালার খুব আঘাত করল। তবুও সে কিছু মনে করল না ,কারণ এর থেকে বড় আঘাত সে তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছে।

      ভর্তি হয়ে গেলাম, নতুন কলেজে ভালোই চলছে। এরপর অনেক কথা, আবার পরে, বেশি লম্বা হলে ভালো লাগবে না।


                                                সুলেখা দেবনাথ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

Comment